এখন গ্রামের পাশের হাওরের শত শত বিঘা জমি গর্ত আর গর্ত। দেখলে মনে হয় বড় এক জলাভূমি। অথচ কয়েক বছর আগেও এই অবস্থা ছিল না টেংগারগাঁও, নোয়ারাই, বাতিরকান্দি, শারপিন এলাকার ফসলি জমির। কেন এই অবস্থা- প্রশ্ন করা হলে কৃষকরা জানালেন, পাশেই লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। প্রতি বছর এই ফ্যাক্টরিতে সিমেন্ট উৎপাদনে ৪ ৫ লাখ টন মাটির প্রয়োজন হয়। কোম্পানির ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রতি বছরই কৃষকদের মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে জমি থেকে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। এতে করে লাফার্জ সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কয়েক মাইল এলাকা এখন জলাভূমি। স্থানীয়রা এ ব্যাপারে প্রশাসন সহ নানা দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে সরজমিন পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে। লাফার্জের এই তাণ্ডবলীলার কারণে ছাতক পৌরসভার অধীনে থাকা তিনটি ওয়ার্ডের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আর ফসলি জমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় আশেপাশের ৫-৬টি গ্রামের বাসিন্দারা বেকার হয়ে পড়েছেন। এশিয়ার সর্ববৃহৎ সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লি. ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাতকের সুরমা নদীর তীরে নোয়ারাই- টেংগারগাঁও এলাকায়। ২শ’ ৫৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে ফ্রান্সের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক বার্ষিক ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, লাফার্জে সিমেন্ট তৈরির আরো একটি অন্যতম উপাদান মাটি সংগ্রহে নতুন জটিলতায় পড়ে কারখানাটি। কারখানা কর্তৃপক্ষ কৃষিজমি থেকে স্থানীয়ভাবে মাটি সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এ সময় কৃষিজমি থেকে মাটি না দেয়ার পক্ষে স্থানীয় লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানায়। কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় স্থানীয় কৃষকরা জেলা প্রশাসক জহির উদ্দিন আহমদ বরাবরে স্মারকলিপিও প্রদান করেন। এক পর্যায়ে লাফার্জ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কৃষিজমির মালিকদের বিভিন্ন আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে কৃষিজমি থেকে মাটি সংগ্রহ করতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু লাফার্জের আশেপাশের মাটি লুটের তাণ্ডব। ছাতকের প্রভাবশালীরা এসে এই মাটি লুটে সক্রিয় হন। এদিকে লাফার্জ সিমেন্ট কারখানায় ডাস্ট ডিভাইডার ব্যবহার না করায় আশেপাশের সবুজ পরিবেশের তখন থেকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্টের উচ্চ শব্দের কারণে আশেপাশের ২৫-৩০টি গ্রামের মানুষ মারাত্মক শব্দ দূষণে ভুগছেন। একাধিকবার পরিবেশ, শব্দ দূষণ, সুরমা নদী ভরাট ও স্থানীয়দের চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও লাফার্জ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কখনোই আমলে নেননি। একবার প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের সাফল্য মূল্যায়ন সভায় প্রধান অতিথি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব জহির উদ্দিন আহমদ ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ইয়ামিন চৌধুরী মাটি সংগ্রহের বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে সমালোচনা করেন। সবুজ পরিবেশ, কৃষিজমি রক্ষা ও শব্দ দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হলে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসন করতে পারলেই লাফার্জ ছাতক তথা দেশের জন্য আশীর্বাদ হবে বলে তখন তারা মন্তব্য করেছিলেন। এদিকে পাহাড়সম মাটি ডাম্পিংয়ের ফলে বসতঘরে ফাটল ও ফাটলের কারণে প্রাণহানির অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ দাবি করে ২০১৪ সালের ১৩ই এপ্রিল লাফার্জের প্ল্যান্ট ম্যানেজার বরাবরে ও মাটি ডাম্পিং ফসলি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত করার অভিযোগে নোয়ারাই এলাকার শুকুর মিয়া চৌধুরী ইউএনও বরাবরে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। ১০ লক্ষাধিক টন মাটি ডাম্পিংয়ের কারণে ২০১২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ডাম্পিং সাইড সংলগ্ন এলাকায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার ৬ ব্যারেল গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার উপাদন ১ সপ্তাহ বন্ধ অবস্থায় ছিল। কনভেয়ার বেল্টের উচ্চ শব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারার ২৫-৩০টি গ্রামের মানুষ শব্দজনিত নানা রোগে ভুগছেন। টেংগারগাঁওয়ের সামাজিক সংগঠন ‘নাগরিক পরিবেশ ও যুব সমাজকল্যাণ সংস্থা’র পক্ষ থেকে গত ২রা সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক বরাবরে এক স্মারকলিপিতে লাফার্জ কর্তৃক পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়- ‘তথাকথিত’ অকৃষি জমিকে কৃষিজমি করার অজুহাতে এলাকার প্রায় শত শত হেক্টর কৃষিজমিকে স্থায়ী অনাবাদী ও জলাভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। প্রশাসন থেকে যে শর্ত সাপেক্ষে মাটি সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয় তা কখনো লাফার্জ কর্তৃপক্ষ ও কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত ঠিকাদাররা মেনে চলেন না। প্রশাসন থেকে তদারকির নিয়ম থাকলেও তা না করায় পরিবেশবান্ধব টিলা, খাসজমি ও ফসলি জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে বলেও স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়। টেংগারগাঁও নাগরিক পরিবেশ ও যুবক সমাজকল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আইনুল আহমদ গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, লাফার্জের এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দেখার যেন কেউ নেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লাফার্জের এসব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ সভা, স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধনসহ অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেও প্রতিকার মেলেনি। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে মাটি লোপাটের চক্রান্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসন থেকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। অপরদিকে, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানায় মাটি সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝেও নানা কারণে ক্ষোভ আর অসন্তোষ বিরাজমান। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কারখানার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরও হয়রানি করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে তাদের কাছ থেকে রেট নেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। ওই সময় আর্নেস্টমানি হিসেবে প্রতি ব্যবসায়ী কোম্পানিকে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা প্রদান করেন। ২০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকার মতো নেয়া হয় আর্নেস্টমানি। সেই টাকা প্রায় মাসখানেক খাটিয়ে ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু করা হয়। কিন্তু যখন ওয়ার্কঅর্ডার ইস্যু করা হয় তখন বৃষ্টির মৌসুম চলে আসায় ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানান, ২০১৭ সালের মূল্য থেকে কমমূল্যে মাটি সংগ্রহের চেষ্টা করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ক্ষোভ আর অসন্তোষের মাঝে ২০১৭ সালে কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাতকে এসে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে ২৯৮ টাকা মূল্য চূড়ান্ত করেন। কিন্তু সেই মূল্যে এখন সংগ্রহ না করে মূল্য কমিয়ে নিতে চাচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ফলে এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ছাতক পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. লিয়াকত আলী জানিয়েছেন, এখন লাফার্জের আশেপাশে অবশিষ্ট মাটি নেই। ঠিকাদারদের মাটি নিয়ে আসতে হবে দূরবর্তী স্থান থেকে। এতে করে খরচ বেশি পড়বে। তিনি জানান, মাটির মূল্য না বাড়ালে ব্যবসায়ীদের কেউ মাটি দেবেন না। লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লি.-এর গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘কৃষিজমিকে অকৃষি নয়-আমরা অকৃষি জমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করছি। তাছাড়া স্থানীয় কৃষকরা স্বেচ্ছায় আগ্রহী হয়ে লাফার্জের কাছে মাটি বিক্রি করছে বলেও দাবি করেন তিনি।’ পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘বিষয়টি নিয়ে যে নীতিমালা বা বিধান আছে আমরা তা মেনেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’